English French German Italian Portuguese Russian Spanish

Related Articles

Search

River Inter Linking Article

৩০ নদীর গতিপথ পরিবর্তনে ভারতের পরিকল্পনায় প্রতিবেশীদের উদ্বেগ

Print

 

রবিবার, ০১ এপ্রিল ২০১২
 

মানবজমিন ডেস্ক: সমপ্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ৩০টিরও বেশি নদীর আন্তঃসংযোগ ও তার পানির প্রবাহকে পরিবর্তন করার নির্দেশ দিয়েছে সরকারকে। এতে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ বলেছে, এমনটা করা হলে তার সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে। যেসব নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখ করার মতো দু’টি হলো- গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র। এ দু’টি প্রধান নদীর নিম্ন অববাহিকায় বাংলাদেশের অবস্থান। এ প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন যোগাযোগও করা হয়নি। শুক্রবার অনলাইন বিবিসি এ খবর দিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর শিরোনাম- ‘কনসার্ন ওভার ইন্ডিয়া রিভারস অর্ডার’। এতে বলা হয়, বহু কোটি ডলারের এ প্রকল্পটি ভারত সরকার ২০০২ সালে ঘোষণা করে। কিন্তু এর পর থেকে তা ছিল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। নেপালের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালে এখন রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল নয়। এ সুযোগকে ব্যবহার করে ভারত বাঁধ ও নেপাল সীমান্তে জলাধার নির্মাণ করার পথ উন্মুক্ত করতে পারে। এটি হবে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত প্রকল্প। ইংরেজিতে যাকে বলা হবে ইন্টার লিঙ্কিং প্রজেক্ট (আইএলআর)। পানি বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভারতের এ প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নেপাল হলো আদর্শ স্থান। ভুটানেও আছে একই ধরনের লোকেশন বা স্থান। এর কতগুলো নদী পতিত হয়েছে ব্রহ্মপুত্রে। এটি ভারতীয় নদী-আন্তঃসম্পর্কীয় প্রকল্পের বড় নদ। দীর্ঘদিনের আপত্তি: এ প্রকল্পের মূল ধারণা হলো- কর্তৃপক্ষ যেখানে মনে করবে পর্যাপ্ত পানি আছে সেই পানির গতি পরিবর্তন করে যে এলাকায় সেচ, বিদ্যুৎ ও মানুষের নিত্যদিনের কাছে পানির ঘাটতি রয়েছে সেখানে প্রবাহিত করবে। ভারতের সরকারি তথ্যমতে, তাদের জনসংখ্যা প্রায় ১২০ কোটি। প্রতিদিনই পানির চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইএলআর উপস্থাপনের চেষ্টা করছে ততই তা নিয়ে বিতর্ক জোরালো হয়ে উঠছে। সমালোচকরা বলছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তারা আরও বলছেন, যেসব দেশের ভিতর দিয়ে নদীগুলো প্রবাহিত হয়েছে তাদের সম্মতি ছাড়া এ প্রকল্প বাস্তবায়ন টেকনিক্যাল কারণে যায় না। আদালত এ প্রকল্প নিয়ে গত মাসের প্রথম দিকে নির্দেশ দেন। তাতে বিচারকরা বলেন, প্রকল্পটির কাজ দীর্ঘদিন বিলম্বিত করা হয়েছে। এতে খরচ বাড়ছে। প্রায় ১০ বছর আগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ হাজার কোটি ডলার। তখন ধরা হয়েছিল এটি শেষ হতে সময় লাগতে পারে ১৬ বছর। আদালত এ প্রকল্পটির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করেছে। তাদের বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য পরিকল্পনা করতে। কিন্তু বাংলাদেশের পানি সম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন বিবিসিকে বলেছেন, এ প্রকল্পে আমরা কখনও রাজি হতে পারি না। এসব নদীর ওপর আমাদের কৃষি, অর্থনীতি ও জীবন নির্ভরশীল। এসব নদীর পানির গতিপথ পরিবর্তনের কথা আমরা কল্পনাই করতে পারি না। ভাটি অববাহিকায় যেসব প্রভাব পড়বে: এশিয়ার বড় দু’টি নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র। এ দু’টি নদীই ভাটিতে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভারত যেসব নদীর গতিপথ পাল্টে দিতে চায় তার মধ্যে এ দু’টি নদী রয়েছে। ভারত চাইছে এর পানির প্রবাহের গতিপথ পাল্টে তা ভারতের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে প্রবাহিত করতে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, দেখে মনে হয় ভারত মনে করছে এ নদীগুলো সীমান্তে এসে থেমে গেছে। ফলে ভাটিতে বাংলাদেশে পানি যেতে পারবে না। এ পানিসম্পদ নিয়ে তারা যদি কোন কিছু করে তবে তাতে যেন ভাটিতে বাংলাদেশে এর কোন প্রভাব পড়বে না! তিনি আরও বলেন, ভারত সব সময়ই মনে করে যে, ব্রহ্মপুত্রে বুঝি বাড়তি অনেক পানি আছে। কিন্তু তাদের দেখে এটা কখনওই মনে হয় না- তারা এ বিষয়টা মাথায় রাখছে যে, ভাটিতে বাংলাদেশ নামে একটা সার্বভৌম দেশ আছে। এদেশটিরও পানির দরকার আছে। মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন জানিয়েছেন, ভারতের তরফে এ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোন আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করা হয়নি। এ প্রকল্পটি নিয়ে নেপাল ও ভুটানকেও অবহিত করা হয়নি। এ বিষয়ে নেপালের জ্বালানিমন্ত্রী পোস্তা বাহাদুর বোগাতি বলেছেন, তিনি ভারতের কাছ থেকে এ প্রকল্প নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোন তথ্যই পাননি। নেপালের পানিসম্পদ বিষয়ক সিনিয়র বিশেষজ্ঞ সান্তা বাহাদুর পুন এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নেপালের ভিতরে বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করতে ভারতকে অনুমোদন দেয়া রাজনীতিবিদদের উচিত হবে না। ভুটান এ প্রকল্প নিয়ে মোটেও খুশি নয়। ভুটানের কৃষি ও বনমন্ত্রী পেমা গিমতসো বিবিসি’র কাছে বলেছেন, আমরা মনে করি নদীগুলোর চলার পথ বহুদেশের ভিতর দিয়ে। তবে এ প্রকল্পের জন্য কোন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ভারতের সঙ্গে সরাসরি কোন কথা হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে: পত্রিকার রিপোর্ট বা একাডেমিক গবেষণা ছাড়া আইএলআর প্রকল্পের বিষয়ে সরকারিভাবে খুব সামান্যই প্রকাশ করা হয়েছে। ২০০৬ সালে ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রীকে পার্লামেন্টে প্রশ্ন করা হয়েছিল- এ প্রকল্প নিয়ে কোন শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে কিনা। তিনি এর একটি সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন- আইএলআর প্রকল্পটি এখনও মাত্র ধারণার পর্যায়ে রয়েছে। এ প্রকল্পটি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণের পরে এর প্রভাব সম্পর্কে বলা যাবে। ফলে এ পর্যায়ে আইএলআর প্রকল্প নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের কোন প্রয়োজন নেই। তবে আইএলআর প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সমপ্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যে আদেশ দিয়েছেন তাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া কি শুক্রবার এ বিষয়ে ভারতের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোন কর্মকর্তা কোন মন্তব্য করেননি। অতীতে পানি নিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত অনেক চুক্তি করেছে। এগুলো নিয়ে রয়েছে তীব্র বিরোধিতা। এখন চীন তার দক্ষিণের নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন করে উত্তরের দিকে পানি প্রবাহিত করতে চায়। এ নিয়ে নয়া দিল্লির মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। চীন তিব্বতে ইয়ারলু-সাংপো নদীতে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। চীন বলেছে, তারা কোনভাবেই ওই নদীর পানির গতিপথ পরিবর্তন করবে না। এ নদীটি ভারতে এসে ব্রহ্মপুত্র নাম ধারণ করেছে। ভারতের প্রধান উদ্বেগের কারণ- এ নদীতে চীনের ওই প্রকল্প নিয়ে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার কারণে পানির বিষয়ে সবার দৃষ্টি থাকবে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি সামপ্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ২০২২ সালের পরে দক্ষিণ এশিয়া হবে বিশ্বের মধ্যে এমন একটি অঞ্চল যেখানে পানিকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে অথবা সন্ত্রাসবাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

 
 
সর্বশেষ আপডেট রবিবার, ০১ এপ্রিল ২০১২ ১৯:২৫
 
 
 

 
 
Source : Manab Zamin
 

ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হলে বাংলাদেশ মরুভূমি হবে

Print

 

 

 

 
 
 
 
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, অব্যাহত পানি আগ্রাসনের মধ্যেও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে ভারতের সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনা বাংলাদেশের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে ভারত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করে এলেও সেদেশের পরিবেশবাদীদের আপত্তি ও উচ্চ আদালতে মামলার কারণে পুরোদমে কার্যকর করতে পারেনি। গত সোমবার সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনার পর মনমোহন সিংয়ের সরকার পরিবেশ বিপর্যয়কারী ও বাংলাদেশের মরণফাঁদ এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর বিরুদ্ধে ভারতে যারা আন্দোলন করছেন তাদের নীরবতার সুযোগে সুপ্রিমকোর্ট সরকারকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে। ভারত যদি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায় তাহলে আগে বাংলাদেশের পানিপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। এজন্য শিগগিরই দু’দেশের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে একটি সমীক্ষা হওয়া জরুরি। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটবে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রকল্পটি বন্ধে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংককে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রেখে যৌথনদী কমিশনের মাধ্যমে যৌথ সমীক্ষা চালানো জরুরি।

শুধু বাংলাদেশই নয়, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প পানি ও পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি রাজ্যসহ পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার নিয়ে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে লাখ লাখ মানুষ উচ্ছেদের শিকার হবে। তাই ভারতেরই পরিবেশবাদীরা প্রকল্পটির বিরোধিতা করছেন। এমনকি যেসব প্রদেশে পানি নেয়ার কথা বলছে তারাও ওইসব পানি নিতে চাইছে না। কারণ অত্যন্ত চড়া দামে কিনতে হবে বিধায় ওই পানি দিয়ে কৃষিকাজ সম্ভব নয়। বৃহত্ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক বেনিয়া গোষ্ঠীর বিশাল ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

তাদের মতে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শীর্ষ বৈঠকে যৌথ নদী বিষয়ে অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাই ভারত ইচ্ছে করলেই একতরফাভাবে অভিন্ন নদীগুলোর ওপর আন্তঃনদী সংযোগের প্রকল্প বা আন্তঃনদী পানি সরানোর প্রকল্প (ইন্টার রিভার ওয়াটার ট্রান্সফার প্রজেক্ট) বাস্তবায়ন করতে পারে না।

যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) কর্মকর্তারা জানান, ২০১০ সালের ১৭ থেকে ২০ মার্চ নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের ৩৭তম বৈঠকে ভারত পরিষ্কার করেই জানিয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করে তারা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না। তাদের মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখন বাংলাদেশকে না জানিয়ে বা নাম পরিবর্তন করে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হলে তা হবে অনাকাঙ্ক্ষিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তীব্র প্রতিবাদ জানাবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে। গতকাল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভিও জানিয়েছেন, তারা ভারতের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। তথ্য পাওয়ার পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।

ভারতীয় সুপ্রিকোর্টের নির্দেশনা : ভারতের সরকারি বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) সংবাদসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য মনমোহন সিংয়ের সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির সুপ্রিমকোর্ট। সর্বোচ্চ আদালত ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সোমবার ভারতের প্রধান বিচারপতি এস কে কাপাডিয়ার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ ওই আদেশ দেন। বেঞ্চের অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি সতান্তর কুমার ও এ কে পট্টনায়ক। কোর্ট বলেছেন, বিশেষ কমিটি প্রতি দু’বছর পরপর এ সংক্রান্ত রিপোর্ট কেন্দ্রে দাখিল করবে, যার ভিত্তিতে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেবে। কোর্টের রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘এটি একটি জাতীয় স্বার্থ ও উন্নয়নের বিষয়। আমরা কোনো কারণ দেখি না, কেন রাজ্যগুলো নদী সংযোগ প্রকল্পটি সফলতার জন্য পিছিয়ে থাকবে, যখন এ প্রকল্প খরায় পীড়িত মানুষকে ক্ষুধামুক্ত করবে ও বন্যায় পীড়িতদের ক্ষয়ক্ষতি থেকে মুক্ত করবে। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের এই রায়কে কেন্দ্র করে এ প্রকল্প নিয়ে আবার নড়েচড়ে বসবে কেন্দ্রীয় সরকার।

আদালত আরও বলেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হওয়ায় এরই মধ্যে এটির প্রাক্কলিত ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। তাই কেন্দ্রীয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলোকে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ ও সমাজকর্মীদের সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট। কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদমন্ত্রী, পানিসম্পদসচিব, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব, পানিসম্পদ, অর্থ, পরিকল্পনা ও পরিবেশ এবং বন মন্ত্রণালয় মনোনীত চারজন বিশেষজ্ঞ। রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি, দু’জন সমাজকর্মী এবং আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ভারত সরকারের পক্ষে মামলায় সহায়তাদানকারী সিনিয়র আইনজীবী রঞ্জিত কুমার।

ভারতেই তীব্র ক্ষোভ : ভারতের নর্দমা বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক মেধা পাটেকার আদালতের নির্দেশনার সমালোচনা করে বলেছেন, ‘সুপ্রিমকোর্ট সোমবার যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তাতে এ প্রকল্পের পরিবেশ ও প্রতিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে তারা যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাননি বলে আমার মনে হয়েছে। শুধু সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনাতেই এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে না। পরিকল্পনা এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শুধু বাংলাদেশ কেন, ভারতের ভাটি অঞ্চলের মানুষও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, ভারতে নদীগুলোর ওপর যেসব বাঁধ নির্মিত হয়েছে, তার মধ্যে কতগুলো শর্তসাপেক্ষে ছাড়পত্র পেয়েছিল। কিন্তু ওইসব বাঁধ তৈরির সময় শেষপর্যন্ত শর্তগুলো পূরণ করা হয়নি। ফলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশসহ ভাটি অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব শুরু হয়েছে।

এদিকে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনার পর দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যসরকারসহ কয়েকটি রাজ্যসরকার সুপ্রিকোর্টের নির্দেশনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী ওমেম চণ্ডি বলেছেন, কেরালা এ নদী সংযোগ বা নদীর পানি ট্রান্সফার কার্যক্রম চায় না। কারণ এ প্রকল্প তার রাজ্যের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তিনি আরও বলেছেন, উচ্চ আদালতের এ নির্দেশনা কেরালার জন্য প্রযোজ্য নয়। ওই নির্দেশনা সেসব রাজ্যের জন্যই প্রযোজ্য যারা মনে করে তাদের প্রয়োজন আছে। এছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, পাঞ্জাব, ছত্তিশগড় ও গোয়া প্রকল্পের তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। গুজরাট, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, উড়িষ্যা এবং মহারাষ্ট্রসহ কয়েকটি রাজ্য শর্তসাপেক্ষে প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজি হয়েছে।

আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প কী : ভারত আগামী ৫০ বছরের ক্রমবর্ধমান পানি ও খাদ্যের চাহিদা মেটানের লক্ষ্যে দেশের ছোটবড় ৩৮টি নদীকে ৩০টি সংযোগকারী খালের মাধ্যমে জুড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ৩০টি নদীর মধ্যে ১৪টি নদী হিমালয়ান অঞ্চলের এবং ১৬টি পেনিনসুলার নদী। পরিকল্পনার মূল দিক হচ্ছে এক নদী বেসিন থেকে পানি অন্য নদী বেসিনে স্থানান্তর করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি সঞ্চিত রাখার জন্য ৭৪টি বিশাল বিশাল জলাধার ও বেশকিছু বাঁধ তৈরি করা হবে। ফলে শুকনো মৌসুমে ওইসব জলাধারের পানি কৃষি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হবে। এতে বন্যারোধ ও খরার আশঙ্কা কমার কথা বলা হয়েছে। ভারতের এ প্রকল্পের ধারণা নতুন নয়। দেড়শতাধিক বছরের পুরনো একটি প্রকল্প থেকে বিজেপি জোট সরকার প্রভাবিত হয়ে প্রকল্পটি হাতে নেয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে বৃটিশ আমলে স্যার আর্থার ১৯৩৯ সালে ব্যাঙ্গালোর কালিকট নাব্যখালের প্রকল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নদীসংযোগের প্রস্তাব দিয়েছিল। পরে সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন হওয়ায় ব্রিটিশরা সেটি করেনি। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙে ২টি, পরে ৩টি রাষ্ট্র হয়। কিছু নদী পরিণত হয় আন্তর্জাতিক নদীতে। ব্রিটিশদের পর পরিকল্পনা করে ১৯২৬ সালে সিপি রামেশ্বর আয়ার, ১৯৭০ সালে এলকে রাও এবং ১৯৭৭ সালে ক্যাপ্টেন দস্তার। দস্তারের প্রস্তাবটি ‘গ্যারল্যান্ড ক্যানাল বা খালের মালা’ নামে পরিচিত ছিল। এসবের আলোকে ১৯৮০ সালে ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় একটি জাতীয় পানি পরিকল্পনার কাজে হাত দেয়। ২০০২ সালের ১৪ আগস্ট ভারতের রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম সংযোগকারী খাল তৈরি আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের নদীগুলোকে জুড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন। ভারত সরকার প্রকল্পের ব্যয় ২০০২ সালে ধরে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি রুপি বা ১১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রাষ্ট্রপতির ঘোষণার পর ভারতের আইনবিদ রণজিত কুমার ভারতের সুপ্রিমকোর্টে জনস্বার্থে একটি মামলা দায়ের করেন। ২০০২ সালের ৩১ অক্টোবর প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়া উচিত বলে রায় দেয় এবং এজন্য ১০ বছর সময়কাল যথেষ্ট বলে ঘোষণা দেন। পরে বাদী আপিল করেন। একই বছর ডিসেম্বর মাসে বিজেপি সরকার শিবসেনা সংসদ সদস্য ও সাবেক ইউনিয়ন মিনিস্টার সুরেশ প্রভুর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করে। প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিকরা অর্থ সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। ২০০৪ সালে দু’দেশের পরিবেশবাদীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন স্থগিত হয়ে পড়ে। যদিও ভারত এরই মধ্যে তার নিজস্ব নদীগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ করে ওই পরিকল্পনার কিছু অংশ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। টিপাইমুখ বাঁধ যার একটি অংশ বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

কীভাবে হবে এ প্রকল্পে : বৃষ্টিপ্রধান উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে পানি খাল কেটে পশ্চিম ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে। অর্থাত্ ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি খাল কেটে রাজস্থান, গুজরাট ও দক্ষিণ ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে, যা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটালেও ওই এলাকার কৃষকদের খুব একটা উপকারে আসবে না। সংযোগ খালের মাধ্যমে গঙ্গা থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হবে গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্থান ও তামিলনাড়ু এলাকায়। এতে গঙ্গায় যে পানি সঙ্কট হবে তা পূরণ করা হবে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দিয়ে। এভাবে মোট ১৭৪ বিলিয়ন কিউসেক পানি পশ্চিম ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে। এতে ওই ভারতের ১৬ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া হবে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের শুরু হবে আসামের ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে। এ নদের পানি অন্যত্র সরাতে হলে গুয়াহাটি অথবা গোয়ালপাড়ায় ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করতে হবে। এ ব্যারাজ আসামের বন্যার পানি দ্রুত সরে যাওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে পরিস্থিতি আরও খারাপ করবে। তাছাড়া পানি সরাতে সংযোগ প্রকল্পের ১৪ নম্বর খালটির মাধ্যমে আসামের বরপেটা, কোকড়াঝাড় ও ধুবড়ি জেলাগুলোতে নদীর মতো খাল কাটতে হবে, যা ওই এলাকার কোনো উপকারে তো আসবেই না, বরং লাখ লাখ মানুষের উচ্ছেদ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটবে।

আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের এক নম্বর খালের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চল দিয়ে নিতে হলে প্রায় ১০০ মিটার উঁচুতে তুলে ডুয়ার্সের উচ্চভূমি দিয়ে পার করতে হবে। এটি অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুঁড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর ও মালদহ জেলাগুলোতে নদীর মতো খাল কাটতে হবে, যা ওই এলাকার কোনো উপকারে তো আসবেই না, বরং লাখ লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করতে হবে এবং ওই অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটবে।

ব্রহ্মপুত্র থেকে গঙ্গায় আনা পানি ১০ নম্বর সংযোগ খালের মাধ্যমে বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর জেলাগুলোর ওপর দিয়ে খাল কেটে দক্ষিণ ভারতে নেয়া হবে, যা ওই এলাকার কোনো উপকারে তো আসবেই না বরং লাখ লাখ মানুষ উচ্ছেদ হবে ও পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। তাছাড়া দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সংগৃহীত পানির সিংহভাগই বাষ্পীভবন হয়ে উবে যাবে।

বিহারের নদীগুলোতে যে পানি আছে, তা ওই এলাকার জন্য যথেষ্ট। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ১২, ২ ও ৩ নম্বর খালের মাধ্যমে মেচি ও কোশি নদীর পানি বিহারের তরাই অঞ্চল দিয়ে এবং গণ্ডক নদীর পানি সমভূমির ওপর দিয়ে গঙ্গায় ফেলা হবে। এতে এসব নদীর অববাহিকার জেলাগুলোতে নদীর মতো খাল কাটতে হবে, যা এই এলাকার কোনো উপকারে তো আসবেই না, বরং সেই লাখ লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করতে হবে এবং পরিবেশ বিপর্যয় হবে।

বিশেষজ্ঞ মতামত : জাতিসংঘের পানি বিশেষজ্ঞ ড. এসআই খান বলেন, ভারতের সঙ্গে পানি বিষয়ে চুক্তি বা দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্রে আমরা বরাবরই বোকামির কাফফারা দিয়ে আসছি। গঙ্গা পানি চুক্তিতে আমাদের অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। চুক্তিতে পানি পাওয়ার গ্যারান্টি ক্লজ যেমন নেই তেমনি পানি না পেলে আরবিট্রেশনের সুযোগও নেই। হিসাব ধরা হয়েছে ফারাক্কা পয়েন্টে প্রাপ্ত পানি। কিন্তু এর আগে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ শূন্য হলে কি শূন্যকেই ভাগ করবে? অথচ গঙ্গার ৭২ শতাংশ পানি আসে নেপাল থেকে এবং ১০ শতাংশ আসে চীন থেকে। আর ভারতের অংশ মাত্র ২০ শতাংশেরও কম। অথচ তারা পুরোটাই নিয়ে যাচ্ছে। এখন আন্তঃনদী সংযোগ বা আন্তঃনদীর প্রবাহ সরিয়ে নেয়ার প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ মরুভূমি হয়ে যাবে। এ অবস্থায় আমাদের সরকারের উচিত ভারতের কাছে একটি যৌথ সমীক্ষার দাবি জানানো। ভারত যদি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতেই চায় তাহলে বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রেখে যৌথ সমীক্ষার ভিত্তিতে আমরা আমাদের পানি পাওয়ার নিশ্চয়তার বিধান রাখা উচিত।

বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আ ন হ আখতার হোসেন প্রকল্পের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, গত সোমাবর সুপ্রিমকোর্ট রায় দিলেও ভারত কখনই এ প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখেনি। তারা গঙ্গা ক্যানেল, টিপাইমুখ বাঁধ, মহানন্দা-গঙ্গা সংযোগ খাল, হিমালয় অঞ্চলে বিভিন্ন বাঁধ ও ক্যানেল তৈরির মাধ্যমে দ্রুততা ও গোপনীয়তার সঙ্গে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো দিনই এর খোঁজ রাখেনি, সমন্বিতভাবে এর প্রতিবাদও করেনি। এখন আদালত নতুন করে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে। এই প্রকল্প আমাদের জন্য বড় বিপর্যয়। তাই দেশের ভেতর প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। জনমত গঠন করে আঞ্চলিকভাবে। ভারতের প্রতিবাদকারীদেরও আমাদের সঙ্গে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালত ও জাতিসংঘে আমাদের দাবিগুলো তুলতে হবে। তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিকভাবে ও সামরিকভাবে শক্তিশালী না হলে তারা এ ধরনের কাজ করতেই থাকবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজন সম্পর্কে তারা জানেন এবং আমার মনে হয় তারাই এটা জিইয়ে রাখে। এ বিভাজন বিভক্তি তারা খুব সূক্ষ্মভাবে কাজে লাগায়। ওই সুযোগে তারা তাদের উদ্দেশ্যগুলো হাসিল করে নেয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির মোস্তফা খান প্রকল্পের মারাত্মক ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরে বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এখন আমরা বর্ষা মৌসুমে যে পানি পাচ্ছি আমরা সেই পানিও পাব না। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্কট দেখা দেবে। বেড়ে যাবে আর্সেনিক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে লোনা পানি প্রবেশ করবে। ধ্বংস হবে সুন্দরবন। শস্য ও পশু সম্পদের উত্পাদন হ্রাস পাবে। মাছের উত্পাদন কমে যাবে। মানুষের মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিবে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ভারতের সুপ্রিমকোর্টের রায় তাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু সেটা আন্তর্জাতিক কোনো নদীর জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। এজন্য নির্দিষ্ট কিছু আইন আছে। বাংলাদেশে আসা তথা আন্তর্জাতিক নদীর পানি প্রত্যাহার করে নিলে বাংলাদেশ সেটা মানতে কোনোভাবেই বাধ্য নয়। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে এর প্রতিবাদ জানানো উচিত।

আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প সম্পর্কে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল মতিন বলেন, ২০০৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের পরিবেশবাদীদের যৌথ আন্দোলনের মুখে ভারত সরকার হিমালয়ভিত্তিক নদীগুলোতে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখে। বাংলাদেশে এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে কয়েকটি সম্মেলন হয়েছে। ওইসব সম্মেলনে ভারতের ৮০ জনের বেশি পরিবেশ কর্মী অংশ নিয়েছিলেন। এ সময়ে ভারত আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ বন্ধ রাখলেও নিজস্ব নদীগুলোতে আন্তঃসংযোগের কাজ অব্যাহত রাখে। এরই মধ্যে এ সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ভারত দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৭০০ বাঁধ নির্মাণ করেছে। এই প্রকল্প ভারতের একটি বহু পুরনো পরিকল্পনা। টিপাইমুখও এ পরিকল্পনার অংশ। ২০০২ সালে এ প্রকল্প নিয়ে তোড়জোড় শুরু হলে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে আন্দোলন শুরু হয়। কারণ এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের ৯টি রাজ্য মরুভূমিতে পরিণত হবে। ফলে দু’দেশের উদ্যোগে যৌথ প্রতিবাদের মুখে তত্কালীন ভারত সরকার পিছু হটে। তিনি বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি নিতে হলে উত্তর-পূর্ব ভারত ও মধ্য-ভারতে অন্তত দু’টি রাজ্যে পাহাড়ের উঁচু প্লেটের ওপর দিয়ে পানি নিতে হবে। এজন্য বিশেষ যন্ত্রচালিত মেশিন ব্যবহার করতে হবে। যা হবে খুবই ব্যয়বহুল। ওই পানি দূর-দূরান্তে নেয়ার সময়ও অনেক অপচয় হবে। এ কারণে ওই সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ প্রকল্পের পানি না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের খরা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে এমনকি বন্যাও হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ওইসব এলাকার পানির সমস্যা দূর হয়েছে। ফলে ওই অঞ্চলে এই নদী সংযোগ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই কমে গেছে। তারপরও ভারতীয় এবং বিদেশি কিছু বেনিয়াগোষ্ঠী এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন চাচ্ছে। কারণ সেখানে বিশাল বিশাল ঠিকাদারি পাওয়া যাবে, বাঁধ হবে, খাল খনন হবে, রাস্তা তৈরি হবে এসবের সঙ্গে জড়িত রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য। ফলে বেনিয়াগোষ্ঠী এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন চাইছে। আবদুল মতিন আরও বলেন, ভারতের সুপ্রিমকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছে। আমরা আগে থেকেই জানতাম এ নিয়ে আদালতে মামলা রয়েছে। আমরা সেখানে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারতাম। কিন্তু আমরা সেটা করিনি। এখন রায় হয়ে গেছে। এখন ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নের কিছু বাধ্যবাধকতা সরকারের ওপর আসে। মজার বিষয় হচ্ছে যাদের জন্য আমাদের নদনদীর পানি সরিয়ে নেবে, ওই এলাকার কৃষক এত দামি পানি নিতে আগ্রহী হচ্ছে না। এই পরিবেশবিদ বলেন, বাংলাদেশের মিঠা পানির তিন ভাগের দুই ভাগই আসে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে ওই নদীর ৬০ ভাগ পানি উজান থেকে চলে যাবে। এমনিতেই চীন ব্রহ্মপুত্রের ওপর বাঁধ নির্মাণের পাঁয়তারা করছে। তার ওপর এ ৬০ ভাগ পানি প্রত্যাহার হয়ে গেলে বাংলাদেশ ও ভারতের ৯টি রাজ্যের জন্য এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
 
 
 
 
 
 

 
 
 

আন্তঃনদী-সংযোগ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা

Print

 

 

সিরাজুর রহমান

 

সভ্যতার আদি ধ্যানধারণা অনুপ্রাণিত হয়েছিল শান্তিপূর্ণ পারস্পরিক সহাবস'ানের স্বপ্ন থেকে। তুমি বেঁচে থাকো, আমাকেও বাঁচতে দাও- এটা সভ্য সমাজের খুঁটি। এর ব্যতিক্রম করা হলে অশান্তি ঘটে। আমাকে আক্রমণ করা হলে আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা আঘাত হানার অধিকার আমার থাকবে- এ বিশ্বাস সব সভ্য সমাজের আইনেও স্বীকৃত। দুর্ভাগ্যবশত মানবজাতি সব সময় সুসভ্য আচরণ করেনি, পরের অধিকারকে সম্মান করতে শেখেনি। তার পরিণতি কখনো মানবজাতির জন্য কল্যাণকর হয়নি। জ্ঞাত ইতিহাসের অজস্র হানাহানি আর যুদ্ধবিগ্রহ তারই পরিণতি।



অথচ মানবজাতি সাধারণভাবে শান্তিতে বেঁচে থাকতে চেয়েছে। মানবজাতিকে শান্তির পথে চলতে সাহায্য করার আশায় প্রথম মহাযুদ্ধের পর লিগ অব নেশনস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে সংস'া যথেষ্ট শক্তি সংগ্রহ করতে পারেনি। জাতিগুলো সংস'ার বিধিমালা মেনেও চলেনি। জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিস্ট শক্তি প্রথমে ইউরোপ ও পরে গোটা বিশ্বের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে চেয়েছিল। একপর্যায়ে জাপানও এই উন্মাদ উচ্চাভিলাষে শরিক হয়। কয়েক কোটি লোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা গিয়েছিল, মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রা কয়েক যুগ পিছিয়ে গেছে সে যুদ্ধে। জাতিসঙ্ঘের পত্তন হয়েছে সব দেশ ও জাতির গ্রহণযোগ্য বিধিমালা প্রণয়ন করে যুদ্ধবিগ্রহের প্রয়োজনীয়তার অবসান করা এবং বিশ্বশান্তি নিরাপদ করার লক্ষ্যে।



‘পরস্য অপহরণ’- অন্যের যা আছে আমি নেব, অন্যের ভাগটা আমি ভোগ করব, এই প্রলুব্ধতা সর্বকালেই সভ্যতার প্রতি প্রধান হুমকি হয়ে রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ সনদের মোটামুটি সাধারণ স্বীকৃতি-সমর্থনের কারণে পরের দেশ দখলের প্রবণতা হ্রাস পেলেও পরের সম্পদ অপহরণের স্পৃহা বরং বেড়েই চলেছে।



এ প্রবণতা সবচেয়ে লক্ষ্যমান নদীর পানির ব্যাপারে। নদীগুলো অনাদিকাল থেকে পাহাড়-পর্বত ও উচ্চভূমি থেকে বহু দেশ পেরিয়ে সমুদ্রে পড়ে। জনবসতি বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির বিকাশের ফলে চাষবাসে সেচ এবং পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীর পানির ব্যবহার অভাবনীয় রকম বেড়ে গেছে। উজানের দেশগুলোর অত্যধিক চাহিদার কারণে ভাটির দেশ প্রায়ই তাদের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পানিও পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বিগত তিন দশক থেকে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন যে, ভবিষ্যতের বড় যুদ্ধগুলোর কারণ হবে নদীর পানির হিস্যা নিয়ে বিরোধ।



জাতিসঙ্ঘ এ দিকেও মনোযোগ দিয়েছে। একাধিক দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদনদী সম্বন্ধে জাতিসঙ্ঘ কনভেনশনের (চুক্তি) পঞ্চম ধারাটি ১৯৯৭ সালের ২১ মে ১০৪-৩ ভোটে গৃহীত হয়েছে। এতে নদীর পানিসম্পদের সুষম ব্যবহার তীরবর্তী দেশগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কনভেনশনের ৭ নম্বর ধারায় নদীতীরবর্তী অন্য দেশগুলোর ‘উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না করার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস'া নেয়া’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।



নদীর পানি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের বর্তমান স্বার্থের সঙ্ঘাতকে জাতিসঙ্ঘ কনভেনশনের পঞ্চম ও সপ্তম ধারার আলোকে বিবেচনা করতে হবে। ভারত দ্রুত উন্নয়নমুখী দেশ। কৃষির জন্য সেচ, কলকারখানার প্রয়োজন আর পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারত অভিন্ন নদীগুলোতে অবিরাম বাঁধ নির্মাণ করে চলেছে। অভিন্ন নদীগুলোতে ভারত এযাবৎ ৫০টিরও বেশি বাঁধ তৈরি করেছে। মাত্র গত সপ্তাহে বৃহত্তর সিলেটের ভেতর দিয়ে প্রবহমান সারি নদীর উজানে নতুন তৈরী পানি-বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধন হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের (সরকারের নয়) প্রবল প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কাজও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।



বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির ওপর ভারতের এসব প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া হবে অভাবনীয়। বাংলাদেশ সীমান্তের উজানে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব বিবেচনা করলেই দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া পরিষ্কার হয়ে যাবে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে ষাটের দশক থেকে সাবেক পাকিস্তানের সরকার প্রবল প্রতিবাদ করে আসছিল। সে কারণে বাঁধটি তৈরি হলেও চালু হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ১৪ দিনের জন্য ‘পরীক্ষামূলকভাবে’ ফারাক্কা বাঁধ চালু করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রস্তাবে সম্মত হন। কিন' সে ১৪ দিন এখন চিরস'ায়ী হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার সাথে ফারাক্কায় গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করেন। চুক্তিতে সি'র হয়েছিল যে, খরার মওসুমে বাংলাদেশকে ৩০ হাজার কিউসেক (বাংলাদেশের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম) পানি দেয়া হবে। কিন' সে পরিমাণ পানিও বাংলাদেশ কোনো বছরই পায়নি।



শুকনো পদ্মা আর রবীন্দ্রনাথের কবিতা


পরিণতিতে গঙ্গার বাংলাদেশ অংশ পদ্মার বেশির ভাগ শুকনো মওসুমে স্রোত থাকে না। পলি জমে জমে নদীর তলা উঁচু হয়ে শুকিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে/পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি/ দুই ধার উঁচু তার/ ঢালু তার পাড়ি।’ পদ্মা ছোট নদী নয়। প্রমত্তা পদ্মাকে নিয়ে বহু কবিতা, গান ও কাহিনী লেখা হয়েছে। কিন' এখন পদ্মায় সব সময় ‘হাঁটুজলও’ থাকে না। মানুষ, গরু আর গাড়ি অনায়াসে এ নদী পার হয়। পানির অভাবে পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে তৈরী গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প অকেজো হয়ে গেছে। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল শুকনো মওসুমে মরুভূমির মতোই উষর। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের নদী মোহনাগুলো পলি জমে জমে উঁচু হয়ে গেছে। জোয়ারে আর সামুদ্রিক বানে বঙ্গোপসাগরের নোনা পানি নদীর উজানে এলে আর নামতে পারে না। লবণাক্ততার কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার একর উর্বর জমি অনাবাদি হয়ে যাচ্ছে। বর্ষায় ভারতীয়রা তাদের বাঁধ রক্ষার জন্য স্লুইস গেটগুলো খুলে দেয়। বর্ষার স্বাভাবিক বৃষ্টি আর স্‌্েরাতের সাথে এই বাড়তি পানি যুক্ত হয়ে ধেয়ে আসে পদ্মা, মেঘনা প্রভৃতি বাংলাদেশের নদীগুলোতে। শুকিয়ে যাওয়া নদীতল সে পানি ধরে রাখতে পারে না। নদীর পার ভাঙে, হাজার হাজার একর উর্বর জমি হারিয়ে যায়। নদীর দুই তীর বন্যায় ডুবে যায়। নদীতল ক্রমেই উঁচু হচ্ছে বলে প্রতি বর্ষায় বন্যা বেশি থেকে আরো বেশি এলাকা ডুবিয়ে দিচ্ছে, সে পানি নেমে যেতেও বেশি থেকে বেশি সময় লাগছে। বন্যায় বার্ষিক ফসল হানি অপরিমেয়। অর্থাৎ ভারতের তৈরী বাঁধগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য শাকের করাত, যেতেও কাটে, আসতেও কাটে। খরা ও বর্ষা- উভয় মওসুমেই বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।


এই হচ্ছে একটি নদী-পদ্ধতির মর্মান্তিক দুর্দশা। তিস্তা-পদ্ধতির অবস'াও এখন সমানেই মর্মান্তিক। টিপাইমুখ বাঁধ চালু হলে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা অঞ্চলও একই রকম ঊষর হয়ে যাবে। শুধু যে ইলিশ মাছ আর আসবে না বাংলাদেশে তাই নয়, বাংলাদেশের পূর্বাংশের পরিবেশ প্রাণী উদ্ভিদ সব কিছু বদলে যাবে।



অর্থাৎ নদীর পানিসম্পদের ‘সুষম ব্যবহার’ করার জন্য জাতিসঙ্ঘ কনভেনশনের পঞ্চম ধারার এবং ‘অন্য দেশের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না করার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস'া নেয়ার’ যে বিধান সে কনভেনশনের সপ্তম ধারায় আছে ভারত ইতোমধ্যেই তা অমান্য করে চলেছে। তার ওপর ১৯৮২ সালে ভারত একটা ‘মেগা প্রকল্প’ তৈরি করেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের নদীগুলোকে একটি খাল দিয়ে সংযুক্ত করে সেসব নদীর পানি মধ্য ভারতের ঊষর অঞ্চলে সেচের জন্য নিয়ে যেতে। ভারতের সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর মানুষ এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। এত বছর পর সুপ্রিম কোর্ট গত সপ্তাহে সে মামলার চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন। রায়ে মেগা প্রকল্পকে বৈধ ঘোষণা করে পরিবেশ-সংক্রান্ত সব ভারতীয় আপত্তি বাতিল করে দেয়া হয়েছে।



আপাতদৃষ্টিতেই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভারতের আইন ও ভারতের স্বার্থ বিবেচনা করে রায় দিয়েছেন। কিন' সে রায়ে যে আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসঙ্ঘ কনভেনশনের পঞ্চম ও সপ্তম ধারার বিরোধিতা করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট সেটা অগ্রাহ্য করেছেন। মেগা প্রকল্পটি নির্মাণ শুরু হলে সেটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারই শামিল হবে।



ভারত যে কারণে সাহস পায় কথা হচ্ছে বাংলাদেশ কি বেঁচে থাকতে চায়? এবং বেঁচে থাকতে হলে বাংলাদেশীদের কী করতে হবে? সাদা চোখেই আমরা দেখতে পাচ্ছি- স্বাধীনতার পর থেকে কোনো সরকারই দেশের জীবন-মরণের এ প্রশ্নটি নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি। স্বাধীনতার সময় থেকেই নাগরিকদের একাংশ সুশীলসমাজের ছত্রছায়ায় এবং ভারতীয় দালালদের সহায়তায় বাংলাদেশকে আবারো ভারতের সাথে সংযুক্ত করার প্রস'তি হিসেবে ‘বাঙালি জাতীয়তার’ ধ্বনি তুলেছে। ‘ওপারের বাঙালিরা’ আমাদের যতই পদাঘাত করুক ‘বাঙালি জাতীয়তার’ পূজারীরা সেসব অগ্রাহ্য করে দাদা-দিদিদের পদলেহন করে চলেছে। বাংলাদেশের স্বার্থ সম্যক উপলব্ধি করার সময় ও সুযোগ দেশের মানুষ পায়নি। অপেক্ষাকৃত সামপ্রতিককালে বড় দল দুটোর একটা বাকশালী স্বৈরতন্ত্র ফিরিয়ে এনে গদি চিরস'ায়ী করার উন্মাদ স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। সে লক্ষ্যে তাদের সর্বশক্তি নিয়োজিত হয়েছে এক দিকে সব প্রকারের গণতান্ত্রিক বিরোধিতাকে নির্মূল করা, অন্য দিকে পাশের বড় দেশের অনুগ্রহ লাভের যথাসাধ্য চেষ্টা করা। রাজনৈতিক বিরোধীদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে। দাড়ি ও টুপি পরিহিত কোনো লোক রাজনীতির কথা বললেই তাকে যুদ্ধাপরাধী বলে জেলে পোরা হয়, ঐক্য-সংহতি বলে যে একটা কথা অভিধানে আছে, আজকের বাংলাদেশে এলে সেটা মনে হয় না।



ভারতের অনুগ্রহ লাভের জন্য এমন কিছু নেই, যেটা বাংলাদেশের বর্তমান সরকার করছে না। আমাদের পররাষ্ট্র-স্বরাষ্ট্র সব নীতি ভারতের মর্জির ওপর নির্ভর করছে। বিদেশী উসকানি ও সহযোগিতায় বিডিআরে বিদ্রোহ ঘটিয়ে ৫৭ জন উচ্চপদস' সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে, বিডিআরকে অবলুপ্ত করা হয়েছে, এমনকি সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিএসএফ এখন খেয়ালখুশিমতো বাংলাদেশীদের হত্যা করছে, বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে আমাদের নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আমাদের কৃষকদের ফসল কেটে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের রেল, সড়ক ও সমুদ্রবন্দরগুলো ভারতের করিডোর ও বহির্বাণিজ্যের জন্য বিনামূল্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর ভৌগোলিক এলাকা যেন এখন ভারতের খেলার সামগ্রী। তারা আমাদের নদী-উপনদী আর খালে বাঁধ নির্মাণ করে ১৩৪ চাকার ট্রাক ও ট্রেইলার চালায়। টিপাইমুখে ভারতের বাঁধ তৈরির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর সাহস বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের নেই।



ভারতের সংযোগ খালটি তৈরি হলে নদীর পানির প্রাপ্যতা আর পরিবেশের ওপর কুপ্রভাবের ভয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগরিকরাই উদ্বিগ্ন। সে জন্যই তারা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিল। বাংলাদেশের আশু কর্তব্য জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা, কেননা; আগেই বলেছি, এ রায় জাতিসঙ্ঘের নদীর পানিসংক্রান্ত কনভেনশনের পঞ্চম ও সপ্তম ধারার বিরোধী। কিন' শেখ হাসিনার সরকার সে আপিল করবে কি? মোটেই মনে হয় না। কেন না শেখ হাসিনা আশা করছেন, ভারতের ‘বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শেই’ তিনি গদি আঁকড়ে থাকতে পারবেন।

 


প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের সাহায্য চাওয়ার জন্য দুর্ভাগ্যবশত আমাদের পরবর্তী সরকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দুর্ভাগ্য এ জন্য বলছি যে, ভারতীয়রা সংযোগ খালটি তৈরি করে ‘ফেইট একম্পলি’ (প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা সৃষ্টি) করে ফেললে সেটার পরিবর্তন সব সময়ই কঠিন হয়। কিন' আমাদের বা নাগরিকদেরও অনেক কিছু করণীয় আছে। সরকার নীরব থাকলেও সব গণতান্ত্রিক শক্তি ও বুদ্ধিজীবীদের উচিত ভারতকে এবং বিশ্বসংস'া ও বিশ্বসমাজকে জানিয়ে দেয়া যে, ভারতের পানি আগ্রাসনের দরুন বাংলাদেশের যে পরিমাণ ভূমি চাষাবাদ ও মনুষ্য বসতির অযোগ্য হয়েছে, সে পরিমাণ ভূমি বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে দাবি করবে।
সরকার যখন নিষ্ক্রিয় তখন দেশকে বাঁচানোর, দেশের ভবিষ্যৎকে বাঁচানোর দায়িত্ব প্রত্যেক নাগরিককে হাতে তুলে নিতে হবে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের একখানি ট্রেন, একটি ট্রাক কিংবা একখানি জাহাজও যাতে যেতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা প্রত্যেকটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য হবে। আর এক বোতল ফেনসিডিলও যাতে বাংলাদেশে না আসে সে দিকে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। বাংলাদেশে আজকাল চমৎকার শাড়ি ও জামাকাপড় তৈরি হয়। তার পরও ভারতীয় শাড়ি পরার বিলাসিতা বর্তমান অবস'ায় গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতীয় শাড়ি-কাপড় বর্জন করা প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী নারীর কর্তব্য হবে। কোনো নারীকে ভারতীয় শাড়ি পরতে দেখা গেলে তাকে সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে।



ইতোমধ্যে অবৈধভাবে যেসব ভারতীয় বাংলাদেশে বাস করছেন, চাকরি করছেন, পেছনে থেকে আওয়ামী লীগ গুণ্ডাদের উসকানি দিচ্ছেন, এমনকি ভোটও দিচ্ছে আওয়ামী লীগকে, ‘সিটিজেন্স অ্যারেস্ট’ বিধির আওতায় তাদের সবাইকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করতে হবে। আর ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ কথা এর পরেও যারা উচ্চারণ করবে, তাদের ধরে জিজ্ঞেস করতে হবে- শেখ হাসিনা ও দীপুমণির বন্ধু মমতা ব্যানার্জি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন কি না, করলে তিনি কেন শুধু সর্বনাশা বর্ষাকালেই বাংলাদেশকে নদীর পানি দেবেন, তিনি কেন বাংলাদেশের পাওনা জমি বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দেবেন না? তাতেও যদি কারো চৈতন্যের উদয় না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, তিনি বাংলাদেশকে বিলুপ্ত করে আবারো অখণ্ড ভারত গড়তে চান। তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেয়া সবার অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে।

 

 

লন্ডন, ০৫.০৩.১২ serajurrahman@btinternet.com
 
http://www.sonarbangladesh.com/writer/SirajurRahman

 

 


 

 

 

Source : Shonar Bangladesh

 
| + - | RTL - LTR