কোনো সিদ্ধান্ত ও অনুমোদন ছাড়াই ড্রেজার দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে জেলার বিভিন্ন প্রশাসনিক দফতরের নাকের ডগায় অবস্থিত গণপূর্ত বিভাগের প্রায় চার একর জমির ৫৩ বছরের পুরনো পুকুরটি। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচারালয় প্রশাসনের সৌন্দর্য বর্ধন এবং পৌরবাসীর সুপেয় পানির চাহিদা মেটানো দীঘির মতো পুকুরটি হঠাত্ করেই কর্তৃপক্ষের অজান্তে ভরাটে প্রশাসনসহ জেলার সব স্তরের মানুষের মাঝে বিরাজ করছে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ।
এছাড়া ১৯৫৯ সালের গণপূর্ত বিভাগের প্রাচীন এ পুকুরটি ভরাট নিয়ে চলছে চরম নাটকীয়তা ও গোপনীয়তা। কে ভরাট করছে প্রশাসন জানে না এবং একে অপরের ওপর দায় চাপিয়েই যেন তারা নিশ্চুপ। ভরাট করা প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএ বলছে, এ ব্যাপারে তারা কিছুই জানে না। পক্ষান্তরে পুকুর মালিক গণপূর্ত বিভাগ বলছে, পুকুর ভরাটের কোনো অনুমোদন ওই দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কাউকে দেয়া হয়নি। তবে স্থানীয় আ’লীগ নেতারা বলছেন, পুকুরটি ভরাট করে ওখানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। জানা যায়, পুকুর ভরাট করে হাসপাতাল নির্মাণের পর্যাপ্ত জমি ওই স্থানে নেই। স্থানীয়দের ধারণা শুধুই ভরাট হবে পুকুর। এতে বাড়বে জনদুর্ভোগ, দেখা দেবে সুপেয় মিঠাপানির অভাব। সৌন্দর্য হারাবে পটুয়াখালী প্রশাসনিক দফতরের কেন্দ্রস্থল। অন্যদিকে ড্রেজিংয়ের ফলে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কে লাউকাঠি নদীর ওপর ৪৮৫.১৫ মিটার দৈর্ঘ্য পটুয়াখালী সেতু। গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালীতে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল করার জন্য সরকারের একটি প্রস্তাবনা রয়েছে। তার আলোকে ওই পুকুরের জমিসহ ১৪.৭৩ একর জমির একটি প্রাথমিক প্রস্তাবনা পাঠানো হয় ঢাকা সংশ্লিষ্ট দফতরের স্থাপত্য বিভাগে। কিন্তু প্রস্তাবিত মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণের ক্ষেত্রে একই স্থানে প্রায় ৩০ একর জমির প্রয়োজন। এ প্রস্তাবনা নিয়ে স্থাপত্য বিভাগ থেকে প্রশ্ন তোলেন সংশ্লিষ্ট স্থাপত্য প্রকৌশলীরা। এর ফলে জেলা গণপূর্ত বিভাগ থেকে ওই স্থাপত্য প্রকৌশলীদের সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য আহ্বান জানানো হয়। ওই স্থানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণের ক্ষেত্রে জমি বরাদ্দ কিংবা অনুমোদনের বিষয়টি যখন যাচাই-বাছাই কিংবা চিঠি চালাচালির মধ্যে সীমাবদ্ধ, ঠিক তখনই স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অজান্তেই ভরাট করা হচ্ছে ৫৩ বছরের পুরনো এ পুকুরটি। সূত্রটি আরও জানায়, বর্তমানে পটুয়াখালী ২৫০ শয্যা হাসপাতালের অনুকূলে রয়েছে প্রায় ১৬.৫ একর জমি। বর্তমানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য গণপূর্ত বিভাগের খণ্ডিত ১৪.৭৩ একর জমির প্রস্তাবনা রয়েছে। আলাদা আলাদা খণ্ডিত জমিতে ৫০০ শয্যার ভবন এবং একাডেমিক ভবনসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে তাতে মেডিকেল কলেজ স্থাপন চূড়ান্তভাবে সম্ভব হবে না। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণের ক্ষেত্রে একই স্থানে প্রায় ৩০ একর জমির প্রয়োজন। ফলে এ পুকুর ভরাট কোনোই কাজে আসবে না। স্থানীয় আ’লীগের একটি মহলের অতিউত্সাহের কারণে পটুয়াখালী গণপূর্ত বিভাগ ওই জমিতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবনা পাঠায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে।
এদিকে ২০০৫ সালে নির্মিত ৪৮৫.১৫ মিটার দৈর্ঘ্য লাউকাঠি নদীর ওপর ২৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত পটুয়াখালী সেতুর মাত্র ২০০ গজের মধ্যে চলছে ওই পুকুর ভরাটের জন্য ড্রেজিং কাজ। ফলে ধসে পড়ার ঝুঁকিতে পড়েছে পটুয়াখালী সেতু। এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কমলেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আমরা জানি না, খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। সেতুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ড্রেজিং করা হলে অবশ্যই বাধা দেয়া হবে।’
পুকুর ভরাটের ব্যাপারে পটুয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম কামরুজ্জামান বলেন, ‘ওই পুকুরের জমিতে মেডিকেল কলেজের জন্য প্রাথমিক একটি প্রস্তাবনা রয়েছে। তবে অনুমোদন কিংবা জমি হস্তান্তর কোনোটাই হয়নি। ভরাটের বিষয় জানা নেই। খোঁজ নেয়া হবে।’ স্থানীয় এক বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, ‘এ পুকুরটি শত শত মানুষের উপকারে আসে। এটি ভরাট হলে দুর্ভোগ হবে সীমাহীন।’
পটুয়াখালী পৌর মেয়র ডা. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, গায়ের জোরে তারা ঐতিহ্যবাহী পুকুরটি ভরাট করছে। মেডিকেল কলেজ স্থাপন পটুয়াখালীবাসীর প্রাণের দাবি— আমরা সবাই চাই এটির সফল বাস্তবায়ন। ‘পুকুর ভরাট করে এখানে একটি মেডিকেল কলেজ হচ্ছে আপনারা ভালো করে এ বিষয়ে পত্রিকায় নিউজ করেন।’ এ ব্যাপারে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক অমিতাভ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শাহ আলম সরদার বলেন, ‘মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ওই পুকুরের জমি প্রস্তাবনায় রয়েছে এতটুকু জানি।’ বিআইডব্লিউটিএ’র উপ-পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ড্রেজিং দফতর সম্পূর্ণ ভিন্ন। ড্রেজার দিয়ে পুকুর ভরাটের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কোনো দফতর থেকে আমাকে কিছু জানানো হয়নি।’ পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সুকুমার বিশ্বাস বলেন, ‘সরেজমিন বিষয়টি দেখতে যাব। কোনো অনিয়ম পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ পরিবেশ সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বরিশাল বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লিংকন বাইন বলেন, ‘পৌর বা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় জলাশয় ভরাট কিংবা ভূমির প্রকৃতি পরির্বতনের জন্য পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেয়ার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ৪ ধারার (১ ও ২), ৬ ধারার ঙ এবং ৭ ধারা অনুযায়ী এ ধরনের জলাশয় ভরাট করা যায় না। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
{jcomments on}