English French German Italian Portuguese Russian Spanish

Related Articles

Search

তিতাস Titas

তিতাসে বাঁধের প্রভাব বিস্তীর্ণ এলাকায়

Print

 

 

 


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীতে নির্মিত বিকল্প সড়ক সোমবার কাটা শুরু হয়। গত বুধবার তিনজন শ্রমিক কোদাল দিয়ে সড়কটি কাটলেও গতকাল কোদালের পরিবর্তে খননযন্ত্র দিয়ে সড়ক কাটা হয়

ছবি: প্রথম আলো

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণের প্রভাব পড়েছে বিস্তীর্ণ এলাকায়। সেচের অভাবে অনেক কৃষকের বুকে হাহাকার। নষ্ট হয়েছে মাছের আধার। ইতিমধ্যে বাঁধ-সড়ক কেটে নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার সড়ক কাটায় আবার গতি এসেছে। এক দশক ধরে তিতাসের নাব্যতা কমছে। তবে ভারতের ভারী পণ্য, বিশেষ করে, ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ পরিবহনে এক বছর আগে নদীতে বাঁধ দিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণের পর নাব্যতা আরও কমেছে। বাঁধের প্রভাবে দক্ষিণে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত পরিবেশ বিপর্যয় হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার শ্যামনগর, বৈষ্ঠবপুর, চিনাইর, বরিশল ও ঘাটিয়ারা; আখাউড়া উপজেলার খড়মপুর, ভবানীপুর, বনগজ, ধরখার এলাকায় গত বুধবার গিয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোথাও পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে না। বাঁধ-সড়ক তৈরির আগে থেকেই এই নদীতে হাঁটুপানি ছিল।’ তিনি জানান, এলাকাবাসীর কেউ কৃষি কিংবা মৎস্য খাতে ক্ষতি হচ্ছে এমন দাবি করেননি। জেলা প্রশাসক বলেন, তিতাস সেতু রক্ষা করতেই মূলত বিকল্প সড়ক তৈরি করা হয়। ভারী পণ্যবাহী ট্রেইলার গেলে সেতুর ক্ষতি হতো। কমেছে গভীরতা: নদীপারের প্রবীণ লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীর গভীরতা ৪০-৫০ ফুটের স্থলে ১০-১২ ফুটে নেমে এসেছে। কোথাও কোথাও এরও কম। প্রশস্ততাও কমে ৪০-৪২ ফুটে এসেছে। তিতাস পরিণত হয়েছে মরা খালে। যেসব স্থানে আগে খেয়া পারাপার ছিল, সেসব স্থানে এখন বাঁশের সাঁকোয় মানুষ পারাপার হচ্ছে। এই দৃশ্য বেশি দেখা গেছে শ্যামনগর গ্রামে। পরিবেশ অধিদপ্তর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সহকারী পরিচালক হাছান আলী প্রথম আলোকে বলেন, নদীর প্রাকৃতিক গতি বাধাপ্রাপ্ত হলে ক্ষতি হয়। তবে বাঁধটির স্থায়িত্ব কম বলে এখানে খুব ক্ষতি হওয়ার নয়। মৎস্য আধার বিনষ্ট: এলাকাবাসী জানান, বাঁধের কারণে তিতাসের দক্ষিণ পারের শ্যামনগর, ভবানীপুর, বৈষ্ঠবপুর, বনগজ, ধরখারসহ কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত মাছ পাওয়া যায় না। বাঁধের দক্ষিণে এক কিলোমিটার দূরের শ্যামনগর গ্রামে এক বছর আগেও ৭০টি জেলেপরিবার নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু এখন এসব পরিবারের অনেকেই পেশা বদলে দিনমজুরি বা মাছের আড়তদারি করছেন। তাঁদের একজন পীযূষ চন্দ্র দাস (৪২) প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বছর ধইর‌্যা এই গাঙে কোনো মাছ পাই না। তাই অহন আখাউড়া বাজারে আড়তদারি করি। পুঁজির অভাবে হেইডাও পারি না।’ শ্যামনগর দক্ষিণপাড়ার জেলে পিপাস দাস জীবিকার তাগিদে মাঝেমধ্যে চার-পাঁচ কিলোমিটার উজানে গিয়ে মাছ ধরেন। বাকি সময় আখাউড়া বাজারে মুটে-মজুরের কাজ করেন। তবে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা স্বপন কুমার সরকার বলেন, বাঁধটি স্থায়ী নয়। তাই বাঁধের জন্য খুব একটা ক্ষতি হয়নি। কৃষকের হাহাকার: বাঁধের দক্ষিণে ১০-১২ কিলোমিটার পর্যন্ত শত শত একর জমি একফসলি। এসব জমিতে শুকনো মৌসুমে ইরি ধানের চাষ হয়। কৃষকেরা জানান, এক বছর আগে ধানবীজ লাগানোর পর থেকে অমাবস্যা-পূর্ণিমায় জোয়ারের সময় দিন-রাত সেচের কাজ চলত। কিন্তু বাঁধ দেওয়ার ফলে জোয়ার-ভাটার কোনো প্রভাব নেই। ফলে সেচের পানির জন্য গত মৌসুমের মতো চলতি মৌসুমেও কৃষকেরা হাহাকার করছেন। সেচযন্ত্রের ক্ষমতা বাড়িয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বাসুদেব ইউনিয়নের অবস্থাপন্ন কৃষক রুস্তম ভুঁইয়া জানান, গতবারের আগের মৌসুমে সেচ দিতে কষ্ট হয়নি। কিন্তু গত মৌসুমে ১৫ অশ্বক্ষমতার পাম্প দিয়ে সেচেও পানি খুব একটা মেলেনি। এবার ২০ অশ্বক্ষমতার পাম্প দিয়ে সেচ দেওয়া হচ্ছে। বাঁধের কারণে অসংখ্য কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান। জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক বলাই চন্দ্র দাস বলেন, তাঁর দপ্তরে কোনো কৃষকই এ বিষয়ে অভিযোগ করেননি। এখন সেচকাজ স্বাভাবিক গতিতে চলছে। পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ পরিবহনে তিতাসে বাঁধ দিয়ে ওই সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৪৭ কিলোমিটার অংশে আরও ১৭টি বিকল্প সড়ক হয়। এক বছর ধরে এই সড়কগুলোর প্রভাবে বর্ষা মৌসুমে আশুগঞ্জের সোনারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘাটুরা, পৈরতলা, রামরাইল, রাধিকা, সুলতানপুর, ভাতশালা ও কোড্ডা এলাকায় তিতাস থেকে আসা খালগুলোতে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়। গতি এসেছে সড়ক কাটায়: বালুর বস্তা ও মাটি ফেলে তিতাসের বুকে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা ৬০০ ফুট বিকল্প সড়ক সোমবার কাটা শুরু হয়। মঙ্গলবার ঠিকমতো কাটা হলেও বুধবার দেখা যায়, মাত্র তিনজন শ্রমিক কোদাল দিয়ে রাস্তা কাটছেন। এ নিয়ে গতকাল প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে গতকাল আবার রাস্তা কাটায় গতি আসে। কোদালের পরিবর্তে খননযন্ত্র (এক্সক্যাভেটর) দিয়ে রাস্তা কাটা হচ্ছে। ভারতের পরিবহন সংস্থা আসাম বেঙ্গল কেরিয়ারের (এবিসি) প্রতিনিধি নিমিত সাহা বলেন, তিতাসের ওপর বিকল্প সড়ক দিনে-রাতে কাটা হবে। নদীর নিচ থেকে ১৪ কি ১৫ ফুট উঁচু বাঁধের একাংশের প্রায় অর্ধেক কাটা হয়ে গেছে। বাকিটা শেষ হতে দুই সপ্তাহের মতো লাগবে।

 

 

Source : Prothom Alo

 

 


 

 

তিতাস নদীতে ঘের আর ঘের

Print

 

লেখক: হোমনা (কুমিল্লা) সংবাদদাতা | শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১২, ৬ ফাল্গুন ১৪১৮

 

Details

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কর্মীরাই মালিক

উপজেলার তিতাস নদীতে ঘের দিয়ে নির্বিচারে পোনা ও মা মাছ ধরা হচ্ছে। ঘেরের মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় এই পোনা ধরা বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার চরের গাঁ, শ্রীমদ্দি, হোমনা, বাগমারা, চুনারচর, ঘাগুটিয়া, দৌলতপুর, পাইকারচর, রামকৃষ্ণপুর ও শোভারামপুরের তিতাস নদীতে শুধু ঘের আর ঘের। এসব ঘেরের মালিকরা বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী সমর্থক। আর মাছ ধরতে একেবারেই ঘন চিকন (চিকন মশারির মত ) জাল ব্যবহার করছেন ঘেরের মালিকরা। এই ঘন জাল থেকে কোন মাছই রেহাই পায় না। এলাকার সচেতন মহল মনে করেন এ অবস্থা চলতে থাকলে তিতাস নদী একসময় মাছ শূন্য হয়ে পড়বে। উপজেলার ঘাগুটিয়া গ্রামের মহসিন মিয়া জানান, দুই তিন বছর আগে স্যারেরা এসে নদীর মাঝে ঘের দিতে মানা করে গেছেন। সে সময় নদীতে লাল নিশান দিয়ে দিছিল। কিছুদিন পরই ঘেরের মালিকরা লাল নিশান তুলে ফেলে দেয়। ঘেরের মালিক জলিল মিয়া জানান, ঘের দিতে অনেক টাকা খরচ হয়। খরচ পোষাতে গিয়ে ছোট-বড় সব মাছই ধরতে হয়। নদী থেকে মাছ ধরতে ঘন জালের বিকল্প নেই। এতে বড় থেকে শুরু করে ছোট মাছ সবই পাওয়া যায়। উপজেলা মত্স্য কর্মকর্তা মোঃ আরাফাত উদ্দিন বলেন, নদীতে ঘের বন্ধ করতে ঘের মালিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গত নভেম্বরে একটি সভা করেছি। তখন ঘের মালিকরা বলেছেন ঘের দিতে তাদের অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তাই তারা ইউএনও এর কাছ থেকে তিন মাসের সময় চেয়ে নেন।

 

 

Source : Ittefaq

 

 


 

 

তিতাস একটি নদীর নাম!

Print

তিতাসের বুক চিরে বিকল্প রাস্তা

ছবি: সৈকত ভদ্র

 

ক্ষণজন্মা সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মদিন গেল কদিন আগে। এদিকে নদীর বুকে গড়া বিকল্প রাস্তার কারণে মুমূর্ষু তিতাস। কেমন আছে তিতাসপারের মানুষ? তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের সেই মালোরাই বা আছে কেমন? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাট ও আখাউড়া ঘুরে এসে লিখেছেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী।

তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না। —তিতাস একটি নদীর নাম, অদ্বৈত মল্লবর্মণ

তিতাসের ঠিক পেটের ওপর দাঁড়িয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাসের লাইন মনে পড়বে, এ-ই তো স্বাভাবিক। কিন্তু কোথায় সে তিতাস? কোড্ডা বাঁধ এলাকায়, নড়বড়ে কংক্রিটের সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে আমরা ইতিউতি তাকাই। উপন্যাসে বর্ণিত তিতাসের খোঁজ করি। বুকভরা ঢেউয়ের বদলে চোখে পড়ে নদীর বুকে গজিয়ে ওঠা রাজ্যের কচুরিপানা; কচুরিপানাখেকো গরুর পাল, একটা নিঃসঙ্গ বক, নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে ইরি ধান লাগাতে ব্যস্ত কৃষককুল আর দু-তিনটে ট্রাক্টর। কেবল দিগন্তরেখার দিকে, যেখানে পাক খাচ্ছে শীতের হালকা কুয়াশা, সেদিকে তাকালেই তিতাসের পুরোনো রূপের খানিকটা দেখা মেলে। দূরে হুইসেল বাজে। ঝমঝম শব্দ হয়। প্রচণ্ড শব্দে পাশের রেলসেতু, এপাশের কংক্রিটের সেতুসুদ্ধ কাঁপিয়ে আন্তনগর রেলগাড়ি চলে যায়, আর তখনই আমাদের চোখ পড়ে নিচে। তিতাসের ঠিক বুক চিরে চলে গেছে লালচে মাটির বিকল্প রাস্তা। ১৩০ কি তারও বেশি চাকার ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রেইলার থেমে আছে বিকল্প রাস্তার শেষ মাথায়। সেতুর পাশের ঢাল বেয়ে নিচে নামলে চোখে পড়ে দুটো কচুরিপানার দঙ্গলে আটকে থাকা দুটো মালবাহী নৌকা। আর এগোনোর পথ নেই। নাওয়ের নাম ভাগ্যলক্ষ্মী। বিকল্প রাস্তায় মাথা ঠেকিয়ে ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’ যেন মাথা কুটে মরছে। যখন এই রাস্তা ছিল না, নদী বেয়ে ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’রা একটানে চলে যেত আখাউড়া বড়বাজার। নৌকা থেকে সরাসরি মাল উঠত বাজারে। এখন সেই দিন নেই। দস্তুরমতো নদী দুই ভাগ করে দিয়ে তৈরি হয়েছে বিকল্প রাস্তা। মাল খালাস করতে হয় বিকল্প রাস্তার ওপরেই। সেখান থেকে ট্রাক্টরে চড়ে মাল যায় বাজারে। ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’র চইয়ের নিচে মুখ বেজার করে বসে ছিলেন মাঝি স্বদেশ চন্দ্র দাশ। কোটরাগত চোখ। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সেই বাপ-চাচার আমল থেকে তিতাস গাঙের মাঝি স্বদেশ। কথা বলতে মুখিয়েই ছিলেন সম্ভবত। ‘নৌকা চালাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আদা, লবণ, পিঁয়াজ, তেল, ময়দা নিয়া যাই। দেড় বছর ধইরা ম্যালা কষ্ট করতেছি। এই বাঁধটার (বিকল্প রাস্তা) কারণে আমাদের সবই অসুবিধা। আগে ষোলোআনা থেইকা এখন চাইরানাও আয় হয় না। খাওনের কষ্ট। এক বেলা খাই তো তিন বেলা খাই না। আমরা চাই, খালি তারা এই বানটা কাইট দিক।’ পাশের নৌকায় বসে এতক্ষণ সব শুনছিলেন আরেক মাঝি স্বদীপ দাশ। গলা মেলালেন স্বদেশ চন্দ্র দাশের সঙ্গে। ‘বাঁধের কারণে মাল আনা-নেওয়া করতে খরচা লাগে বেশি। রাস্তার কারণে ডাকাতি বাড়ছে। সেই দিনগা আমার মোবাইল-টাকাপয়সা নিয়া গেছে গা...’ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন স্বদীপ। এর মধ্যেই ওপরে রেলসেতুতে আরেকটা ট্রেন আসে। তাঁর কণ্ঠ চাপা পড়ে যায়। আমরা সে সুযোগে এসব ম্লান মুখ মাঝিকে ছেড়ে সেতুর উল্টো পাড়ে যাই। সেখানেও সেই একই হাহাকার। ডিঙি নৌকায় বসে বিরস মুখে হুক্কা টানছিলেন হারাধন দাশ, অর্জুন দাশ, নিরোদ মোহন প্রমুখ জেলে। সেই ভোরবেলা তিতাসের বুকে মাছ ধরতে বেরিয়েছেন তাঁরা ছয়জন। এই ভরদুপুরে এসে প্রাপ্তি বলতে খলুইয়ে জমা হয়েছে তিনটে মাঝারি আকারের বোয়াল মাছ। ‘আগে মনে করেন ২০-২৫ হাত জল ছিল এইখানে। এহন বাঁধের কারণে জল চলাচল করতে পারে না। পাঁচ-ছয় হাত পানিও নাই। তার কারণে মাছও নাই।’ বলতে বলতে জেলে দল নৌকা ঘোরায়। অভাব-অভিযোগ জানিয়ে খুব বেশি লাভ হয় না—এটা সম্ভবত এদ্দিনে বেশ বুঝে গেছেন তাঁরা। তিতাসপারের খড়মপুরের বাসিন্দা জেলে রাধারমণ দাস (৫৮) বলেন, ‘তিতাসে আগে জাল ফালাইলে ১০ থেকে ১৫ জাল্লা মিলেও তুলতে পারতাম না। এখন নদীতে মাছ নাই। আর নদীর মাইঝখানে যে বান দিছে, এর লাইগা এখন এই দিগে মাছও ভিড়ে না।’ তিতাসের পাড় থেকে খানিক দূরে তাকালেই দূরে চোখে পড়ে ঢিবির মতো উঁচু হয়ে থাকা ঘন গাছগাছালির সারি। ওগুলো মানুষের বসতবাড়ি। ধানখেতের আইল, দুটো ন্যাড়া মাথার অচিন বৃক্ষ, একটা ছোট কালভার্ট ইত্যাদি পেরিয়ে আমরা তেমনই একটা ভিটেতে পা রাখি। ভিটের মুখেই বসে বিড়ি ফুঁকছিলেন মস্তু ভুঁইয়া। পেশায় বর্গাচাষি। নদীর বুকে বাঁধ নিয়ে বেজায় আপত্তি এই ৬৫ কি ৭০ বছর বয়সী মানুষটারও। ‘বাঁধের কারণে উজানের পানি সরতে পারে না। ফসলাদি নষ্ট হয়।’ চাষের পানি তা-ও এখন পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু কদিন পরে নদীর বুক শুকিয়ে গেলে পানি কোথায় মিলবে জানেন না এই প্রবীণ চাষি। মস্তু ভুঁইয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে সৌদি আরবপ্রবাসী জোয়ান ছেলে আলমগীর। তারপর বলে সেই চিরাচরিত কথা, ‘ভাই, আমাদের জন্য কিছু ল্যাখেন। বাঁধ হওয়ার পর থেইকা এইখানে রাইতে চলাফেরা হেভি রিস্ক। নানান এলাকার মানুষ আসে। সরকার যদি এখানে অন্তত একটা পুলিশ ফাঁড়ির ব্যবস্থা করে।’ পুলিশ ফাঁড়ির ব্যবস্থা কীভাবে হয়? কেন বহতা নদীর বুক চিরে তৈরি হয় বিকল্প সড়ক? গাঙ শুকিয়ে গেলে মাঝিরা কীভাবে বাঁচে? তিতাসের কূল ঘেঁষে শ্যামনগর, খড়মপুর ঘুরতে ঘুরতে এসব বিবিধ প্রশ্ন এসে আমাদের জাপটে ধরে। প্রশ্নের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে আমরা আবার পড়িমরি কোড্ডা বাঁধ এলাকার পিচঢালা রাস্তায় উঠে আসি। সেখান থেকে মোটরসাইকেলযোগে সোজা আখাউড়া। তারপর আখাউড়া টু ঢাকা, মহানগর গোধূলী। কু-ঝিকঝিক, কু-ঝিকঝিক। তিতাসপারের সাহিত্যিক ও অদ্বৈত মল্লবর্মণ গবেষক জয়দুল হোসেনের কবিতা দিয়ে লেখাটা শেষ করা যেতে পারে: তিতাসের নামাবলী হয়েছে কখন তিন তাস থেকে নাকি ত্রিকালে দহন ত্রাস ছিল নদীজলে ত্রিমুখী সে ত্রাস ত্রাসের কবলে নদী হয়ে গেছে গ্রাস গ্রাস করা নদীজলে বাঁধ দিয়ে যায় বাঁধন মানে না নদী প্রতিবাদ চায় নদী তুমি প্রতিবাদী ঝড় তুলে দাও।

 

 

 

Source : Prothom Alo

 


 

 

তিতাস এখন মরাখালে পরিণত : দখলে সংকোচিত, দুই তীরের দুই শতাধিক সেচ প্রকল্প বন্ধের পথে

Print

 

 

13th April, 2013

 

 

কুমিল্লা উত্তর থেকে মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন মোল্লা :দেশের পূর্বাঞ্চলের ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত নবীনগর উপজেলা দিয়েকুমিল্লা জেলার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের হোমনা উপজেলা হয়ে তিতাস উপজেলার দড়িকান্দি থেকেদুইটি শাখার একটি শোলাকান্দি অপরটি শাহপুর হয়ে লালপুর দিয়ে গোমতীমেঘনামাঠিয়া নদীরমোহনায় পতিত হওয়া অতীতের ঐতিহ্যইতিহাস ও সাহিত্যÑসংস্কৃতি খচিত এক সময়ের খরস্রোতাপ্রমত্তা তিতাস নদী এখন এক মরা নালায় পরিণত হয়ে বিলুপ্তির পথে। ২০১১ সালে কুমিল¬াএলজিইডি লালপুর থেকে শোলাকান্দি গ্রাম পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে তিতাস নদীর একটিশাখার মুখ বন্ধ করে দেয়ার ফলে ব্রাহ্মনবাড়িয়া পর্যন্ত ৪৫ কিঃ মিঃ নদী ও নদীরদু’পাড়ের হাজার হাজার বিঘা ফসলী জমি বর্ষা মৌসুমে ভারতের পাহাড়ী ঢলে নেমে আসা বালিরআস্তরণে ভরাট হয়ে গেছে। আর অপর শাখাটিও ভরাট হয়ে সরু নালায় পরিণত হয়েছে। তিতাস নদীরমুখ থেকে ৪৫ কিঃ মিঃ নদীর বেশির ভাগ স্থানেই চর জেগে উঠেছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরাবাড়িঘরসহ নানা স্থাপনা নির্মান করে দখলে নিয়ে গেছে। ফলে নদীর দু’তীরের প্রায় দুইশতাধিক সেচ প্রকল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম। যার কারণে সেচের অভাবে চলতি বছরে এ অঞ্চলেরলক্ষাধিক বিঘা জমিতে ইরি- বোরো ধানের উৎপাদনে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে বলে স্থানীয়কৃষক এবং বিশিষ্ট জনেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষি, মৎস্যও পরিবেশে দেখা দিতে পাড়ে চরমবিপর্যয়। এমনকি স্থানীয় অর্থনীতিতেও বড় ধরনের প্রভাবপড়তে পারে বলে স্থানীয় অভিজ্ঞ মহল ধারনা পোষণ করছেন। স্থানীয় কৃষকরা বলেন, রহস্যজনকভাবে এলজিইডি তিতাস নদীর মুখে বাঁধ নির্মাণ করেএ অঞ্চলের অর্থনীতিকেহুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।


ঐতিহ্যবাহী তিতাস নদী আজ অস্তিত্বহীন। একসময় তিতাসনদীর বুক দিয়ে চলতো বড় বড় নৌকা আর জাহাজ। ভাটিয়ালী গানের সুরে মহানন্দে নৌকা চালাতমাঝিÑমাল্ল¬ারা। এ সবই আদি তিতাসের স্মৃতিকথা। আজ স্রোতস্বিনী তিতাস নদী ভরাট হয়েমহা অস্তিত্বসংকটে পতিত। এককালেরস্রোতস্বিনী তিতাস নদীকে উপজীব্য করেইব্রাক্ষণবাড়িয়ার কালজয়ী কথাসাহিত্যিক অদ্বৈত মল¬বর্মণ “তিতাস একটি নদীর নাম” নামেবিখ্যাত উপন্যাস রচনা করেছিলেন। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক এ উপন্যাসঅবলম্বনে ১৯৭৩ সালে মনমাতানো ছবি তৈরি করেছিলেন” তিতাস একটি নদীর নাম”। আর এ ছবিরনায়িকা ছিলেন কবরী সারোয়ার এমপি। কুমিল¬ার তিতাস উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তিতাসনদীর নামেই নবগঠিত উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে ‘তিতাস উপজেলা’। ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলারআখাউড়া থেকেকুমিল্ল¬ার তিতাস উপজেলা পর্যন্ত নদীর দুই তীরে অসংখ্য ঘাট ও বাজারগড়ে উঠেছিল। এসব স্থানে ভির করতো মালবাহী বড় বড় নৌকা ও স্টিমার। এ নদীকে ঘিরেতীরবর্তী বাজার ও ঘাটগুলোতে গড়ে উঠেছিল বিশাল পাটের বাজার। বাজারে ছিল অসংখ্য পাটেরগুদাম। তিতাস নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে বড় বড় ব্যবসা কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।এলাকার জেলেদের দুর্ভোগ এখন চরমে। এক সময় জেলেরা নৌকা ও ডিঙ্গি দিয়ে সারা বছরই মাছধরত। এ মাছ বিক্রি করে সুখÑশান্তিতে তাদের দিন কাটতো। তিতাস নদীর এ করুন অবস্থারদরুণ নদীর বেশিরভাগ স্থানে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকে শুষ্ক মৌসুম শুরুহওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর পানি শুকিয়ে যায়। ফলে স্থানীয় পদ্ধতির সেচ ব্যবস্থাবিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নদীর দু’তীরের বহু সেচ প্রকল্প ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকেনদী শুকিয়ে যাওয়ায় নদী কেন্দ্রিক অভিন্ন এলাকায় মাছের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকমাছ কালের গর্ভে ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হলে তিতাস নদীকেবাঁচাতে হবে। ড্রেজিং করতে হবে তিতাস নদীকে। ফিরিয়ে দিতে হবে এ নদীর ঐতিহ্য আর অতীতইতিহাসকে। আর তা না হলে কুমিল¬ার উত্তরÑপশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশ খাতেদেখা দিতে পারে মারাত্মক বিপর্যয়। স্থানীয় অর্থনীতি পড়তে পারে হুমকির মুখে।সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এমদাদ আখন্দের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিতাস নদী খননের ব্যাপারে আমি উপর মহলে লিখিতভাবে প্রস্তাব পাঠিয়েছি।

 

 

Source: dailyinqilab

 

 


 

 

 

{jcomments on}

 
| + - | RTL - LTR