শুক্রবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২, ৩০ ভাদ্র ১৪১৯
রাজধানীর নিষ্কাশিত ময়লা আবর্জনার শতকরা ৭০ ভাগের উপর ঢাকা ওয়াসার কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। অনিয়ন্ত্রিত এই বর্জ্য ওয়াসার পানি (storm water) নিষ্কাশনের পাইপ দিয়া সরাসরি বুড়িগঙ্গায় পতিত হইতেছে। এই কথা স্বীকার করিয়াছেন খোদ ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সম্প্রতি এই বিষয়ে নাতিদীর্ঘ রিপোর্ট প্রকাশিত হইয়াছে একটি ইংরেজি দৈনিকে। প্রকাশিত রিপোর্টে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বরাত দিয়া বলা হয়, ওয়াসার কোনো স্যুয়ারেজ লাইন বুড়িগঙ্গায় পতিত হয় নাই। পাগলায় স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট রহিয়াছে। স্যুয়ারেজ পাইপ লাইন উহার সঙ্গে যুক্ত। তবে স্টর্মওয়াটার অর্থাত্ বৃষ্টি ও বন্যার পানি নিষ্কাশনের জন্য ওয়াসার পৃথক পাইপ লাইন রহিয়াছে। যাহা গিয়া পড়িয়াছে বুড়িগঙ্গায়। এমতাবস্থায় বুড়িগঙ্গায় কিংবা ঢাকার পার্শ্ববর্তী কোনো নদীতে নিষ্কাশিত বর্জ্য যাইবার কথা নয়।
কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। বুড়িগঙ্গা বিষাইয়া গিয়াছে অনেক আগেই। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে টনকে টন ময়লা আবর্জনা পড়িতেছে ঢাকার হূিপন্ড বলিয়া পরিচিত বুড়িগঙ্গায়। এই নদীবক্ষের বাতাসে এখন কেবলই দুর্গন্ধ। পানি কালো হইয়া গিয়াছে। একদিকে আবাসিক-অনাবাসিক এলাকার টয়লেটের বর্জ্য, অন্যদিকে শিল্প কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য পড়িয়া বুড়িগঙ্গার পানি আজ এতটাই দূষিত হইয়া গিয়াছে যে, এই নদীতে মাছ তো দূরের কথা কীটপতঙ্গও বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। বুড়িগঙ্গার পানি শোধন করিয়া ব্যবহার করিবার অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছে। ইহার পাশাপাশি পলিথিন ও অন্যান্য অদ্রবণীয় বর্জ্য পড়িয়া এই নদীর তলদেশে পুরু আস্তরণ পড়িয়া গিয়াছে। তলদেশের জমাট আস্তরণ অপসারণ করিবার প্রকল্প গ্রহণ করা হইয়াছিল। কাজও শুরু হইয়াছিল। কিন্তু ফলোদয় হইয়াছে সামান্যই। বুড়িগঙ্গাকে আজ আর নদী না বলিয়া প্রশস্ত নর্দমা বলিলে অত্যুক্তি হয় না।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও নদীতে ময়লা আবর্জনা নিষ্কাশিত করিবার পথ বন্ধ হয় নাই। এই প্রসঙ্গে ওয়াসার জবাব এই যে, শহরের এক শ্রেণীর মানুষ রাতের অন্ধকারে তাহাদের বাসভবনের স্যুয়ারেজ পাইপ ওয়াসার স্টর্ম ওয়াটার পাইপ লাইনের সঙ্গে যুক্ত করিয়া দিয়াছে। এই বিষয়ে ওয়াসা কিছু জানে না।
একশ্রেণীর পুরবাসীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগটি গুরুতর নিঃসন্দেহে। আপাত সুবিধার কথা বিবেচনা করিয়া যিনি বা যাহারা এই ধরনের কান্ডজ্ঞানহীন কাজ করিয়া চলিয়াছেন, তাহাদের নাগরিকবোধ লইয়া প্রশ্ন উঠিতে পারে অবশ্যই। তাই বলিয়া এই ক্ষেত্রে ওয়াসার কোন দায়দায়িত্ব নাই বা থাকিতে পারে না তাহা বলা যায় না। বিভিন্ন আবাসিক এলাকার বাসাবাড়ির মালিকদের মধ্যে এমন অনেকে হয়তো আছেন, যাহারা নগর শৃংখলা এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ লইয়া মোটেই ভাবিত নহেন। কিন্তু ইহাও মানিয়া নেওয়া কঠিন যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো না কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ ছাড়াই তাহারা বাড়ির স্যুয়ারেজ লাইন ওয়াসার স্টর্ম ওয়াটার লাইনে যুক্ত করিয়া দিতে পারিয়াছে। একখানা মোটা সুঁই কিংবা পেরেক দিয়া গোপনে গাড়ির চাকা পাংচার করিয়া দিবার মত ব্যাপার ইহা নয়। কোদাল-শাবল লইয়া রাস্তা খুঁড়িয়া তবেই স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগ দেওয়া সম্ভব। এইরূপ ঘটনা চক্ষের আড়াল দিয়া চোখের পলকে হইয়া যাইবার কোনোই কারণ নাই। প্রশ্ন হইল এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়া চলিয়াছে অথচ ওয়াসার কর্মকর্তারা তাহা দেখিতে পান না। সত্তরভাগ স্যুয়ারেজ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে, তাহাও তো আর একদিনে যায় নাই। দিনের পর দিন এইরূপ কাণ্ড কী করিয়া চলিতে পারিল তাহাই জানিবার বিষয়। উপসংহারে আমাদের বক্তব্য এই যে, নিয়ম-নীতি ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নগরবাসী কেহই অস্বীকার করিতে পারেন না। নগরীর পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় সকলকেই সচেতনতার পরিচয় দিতে হইবে। সেইসাথে পয়ঃপ্রণালি তথা নিষ্কাশিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যাহাদের, তাহাদেরও কর্তব্য-কর্মে নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার স্বাক্ষর রাখিয়া যাইতে হইবে। অন্যের কাঁধে দোষ চাপাইয়া দিয়া দায় এড়াইয়া যাইবার কোনোই সুযোগ নাই।
Source : Ittefaq